বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত নগরী। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গাণিতিক হিসেবে তা বেশি না হলেও গতকাল সকালে টানা মুষলধারে বর্ষণে নিমজ্জিত নগরীতে পরিণত হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সকালের বৃষ্টির পানির সাথে দুপুরের জোয়ারের পানি যুক্ত হয়ে দীর্ঘস’ায়ী হয় জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ। তবে দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে সীতাকুণ্ডে ২৪০ মিলিমিটার।
নগরীর উঁচু এলাকাগুলো ছাড়া এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে জলাবদ্ধতা হয়নি। কোথাও নালা ব্লকেজ হয়ে রাস্তায় পানি জমেছে। আবার কোথাও নালা উপচে রাস্তায় পানি চলে এসেছে। যেভাবেই হউক রাস্তা, ঘরবাড়ি ও মানুষের দোকানপাটে পানি উঠেছে।
মূল সড়ক থেকে অলিগলি সবখানেই পানি। কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর সমান। এতে চরম দুর্ভোগে দিন পার করেছেন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। অনেককে দিনভর পানিবন্দী হয়ে দিন পার করতে হয়েছে। চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এছাড়া এলাকার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের উপসি’তি ছিল কম। মার্কেট ও দোকানপাটগুলো ছিল ক্রেতাশূন্য, হয়নি বেচাবিক্রি। ফলে অলস সময় কাটিয়েছেন অনেকে। গত সোমবার রাত থেকেই হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল।
তবে সকালের টানা বৃষ্টিতে নালার পানি ফুলে-ফেঁপে রাস্তায় উঠতে শুরু করে। ১০টা বাজতে না বাজতেই রাস্তার উভয়পাশ পানির নিচে চলে গিয়ে তা খরস্রোতা নদীতে পরিণত হয়। সে পানিতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আটকা পড়ে যাত্রীবোঝাই সারি সারি যানবাহন। এতে দুর্ভোগে পড়ে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রী, অফিসগামী লোকজন ও কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া নানা পেশা ও কাজের মানুষজন। এ দৃশ্য দেখা গেছে নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইট থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত এলাকায়।
সিডিএ এভিনিউ সড়কটি হলো শহরের মেরুদণ্ড। এই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে হলো পুরো শহরে অচলাবস’ার সৃষ্টি হওয়া। এ সড়কের পাশাপাশি শুলকবহর, কাতালগঞ্জ, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় পানি জমায় সেখানকার রাস্তাগুলোতেও সৃষ্টি হয় জলজট ও যানজট। সকাল থেকে শুরু হওয়া জলজটের সেই দুর্ভোগ দুপুর ২টায়ও অবসান হয়নি। সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, শুলকবহরের সামনের রাস্তায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী বহনকারী একটা বাস পানিতে আটকে থাকতে। ঘণ্টাখানেক পরও বাসটিকে সেই একই জায়গায় আটকে থাকতে দেখা গেছে। কারণ বাসটির সামনে পেছনে সারি সারি যানবাহন আটকে থাকায় আর কিছুই করার ছিল না।
কথা হয় নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির গেটের মুদি দোকানদার মোহাম্মদ আলীর সাথে। দোকানে পানি ঢোকায় তিনি বেচাবিক্রি বন্ধ করে পানি নামার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বলেন, আমার কারও কাছে কোন অভিযোগ নেই। কারণ অভিযোগটা করব কার কাছে? জনসাধারণের অভিযোগ শোনার মতো সেরকম কেউ কি এ নগরে থাকে? আসলে আমরা বড় অসহায়!
গতকাল সরেজমিন নগরীর চকবাজার কাঁচাবাজার, পশ্চিম বাকলিয়ার ডিসি রোড, গনি কলোনি, ফুলতলা, কেবি আমান আলী রোড, সবুজবাগ আবাসিক এলাকা, রসুলবাগ আবাসিক এলাকা, বড় মিয়া মসজিদ, হাজী সালেহ আহমদ রোড, বাকলিয়া প্রিমিয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ গলি, বড় মিয়া মসজিদ, সিলভার স্কাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ গলি, সৈয়দ শাহ রোড, আতুরার দোকান, রাহাত্তারপুল, চাঁন্দাপুকুর পাড় এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায় সর্বত্র পানি। এসব এলাকাগুলোর নিচতলার বাসাবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মার্কেট ও দোকানপাটের ভিতর পানিতে থৈ থৈ। অনেককে দেখা গেছে মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত সময় কাটাতে।
পশ্চিম বাকলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নিচতলা ডুবে ছিল পানিতে। ছাত্র-ছাত্রীদের উপসি’তি ছিল কম।
কথা হয় চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের দিদার স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মোরশেদুল আলম এর সাথে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই চিন্তা বাড়ে এখানকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের। মালামাল রক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় সকলকে। দোকানের সামনে ড্রেনটি পরিষ্কার হচ্ছে না তিন বছর ধরে। টানা বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়।’
চকবাজার কাঁচাবাজার এলাকার ফরিদপুর স্টোরের ম্যানেজার স্বপন দাশ বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টায় দোকান খুললেও বেলা ১২টা বাজে এখনও এক টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। রাস্তায় পানির কারণে ক্রেতার দেখা নেই।
সবজি বিক্রেতা মো. শাহেদ বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) সকাল-দুপুর ১টা পর্যন্ত ৫০ টাকা বিক্রি করলাম। তার মধ্যে ২০ টাকার নাস্তা খেয়ে ফেললাম। পানির ভয়ে ক্রেতারা এদিকে আসছে না।’
চকবাজার বাকলিয়ার মতো নগরীর আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর কে ব্লক, এল ব্লক, জে ব্লক প্রভৃতি এলাকা ছিল পানিবন্দী। দুপুরের পর থেকে উঠা পানি বিকেলেও নেমে যায়নি। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি মিলে একাকার হয়েছে এসব এলাকায়।
এদিকে প্রবল বর্ষণের কারণে বরাবরের মতো হাটহাজারী সড়কের বড়দীঘির পাড় এলাকা হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল বেলা ১টার দিকে দেখা গেছে, স’ানীয় ভূমি অফিসের সামনে উত্তর-দক্ষিণে অন্তত ২০০ ফুট এলাকায় হাটহাজারী সড়কের অংশ পাহাড়ি ঢল এবং বৃষ্টির পানিতে হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে গেছে। এ কারণে চট্টগ্রাম শহর এবং পার্বত্য রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি অভিমুখী যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ভোগান্তিতে পড়েন বিপুল সংখ্যক মানুষ। অবশ্য বিকাল তিনটার দিকে পানি সরে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানিয়েছেন স’ানীয়রা।
জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ প্রসঙ্গে সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী আহমেদ মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘জোয়ারের কারণে নগরীতে পানি জমেছে। বৃষ্টির সময় কোনো এলাকায় পানি জমেনি। আর আমরা যেসব এলাকায় কাজ করেছি সেসব এলাকায় বৃষ্টির সময় পানি জমেনি।’
অনেক এলাকায় তাহলে যে পানিগুলো জমেছে সেগুলো কিসের পানি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেগুলো জোয়ারের পানি। জোয়ার নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পানিও নেমে গেছে।
কিন’ ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় তো জোয়ারের পানি নয় সেগুলো বৃষ্টির পানি আটকে পুরো পানি রাস্তা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় উজান থেকে নেমে আসা পানি নিচের দিকে নেমে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা পাচ্ছে না। বক্স কালভার্টের পাশাপাশি পানি চলাচলের রাস্তাটি সরু হয়ে যাওয়ায় পানি রাস্তায় উঠে যাচ্ছে।
এদিকে ভারী বর্ষণের সতর্কতা থাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগরীর ঝুঁকিপূর্র্ণ পাহাড়গুলোতে মাইকিং শুরু হয়েছে। কেউ যাতে পাহাড়ের পাদদেশে থাকতে না পারে সেজন্য তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
বৃষ্টি থাকবে ২৯ জুলাই পর্যন্ত
মৌসুমী বায়ু সক্রিয়তায় চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল চট্টগ্রামে ১২২, সন্দ্বীপে ১৭৬ ও সীতাকুণ্ডে দেশের সর্বোচ্চ ২৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া বর্ষণ কতোদিন চলবে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঢাকা কেন্দ্রের পূর্বাভাস কর্মকর্তা রুহুল কুদ্দুস বলেন,‘ ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মৌসুমী বায়ু সক্রিয়তার কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং তা আগামী ২৯ জুলাই পর্যন্ত চলবে। তবে ধীরে ধীরে বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসবে। একুশে মিডিয়া।”
No comments:
Post a Comment