![]() |
একুশে মিডিয়া, বিনোদন রিপোর্ট:
এক বছর ধরে জানাশোনার পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডাপ্রবাসী শামীমা আক্তার অর্নিকে বিয়ে করেন মডেল ও অভিনেতা কাজী আসিফ রহমান। বিয়ের দুই বছর পর তাদের সংসারে আসে এক মেয়ে সন্তান, যার নাম আজওয়াহ রহমান খান। কিন্তু তৃতীয় বছর না যেতেই ভাঙন। স্ত্রীর করা মামলায় কারাগারে যান আসিফ। এখন আছেন জামিনে। এ নিয়ে বহু জল ঘোলা হওয়ার পর এই অভিনেতা দাবি করছেন, তার স্ত্রীর উপস্থাপন করা সব কাগজপত্র ছিল জাল। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে তাকে।
১২ জুলাই, বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে কথা বলার সময় প্রিয়.কমের কাছে এমন দাবি করেন বিজ্ঞাপন ও টিভি নাটকের জনপ্রিয় এই অভিনেতা।
আলাপকালে আদালতে সাবেক স্ত্রীর দেওয়া কাগজপত্রকে শুধু ভুয়াই বলেননি আসিফ; নিজ বক্তব্য জোরালো করতে ইমেইলে এই প্রতিবেদকের কাছে পাঠান কিছু নথি। এগুলোকে আসল বলে দাবি করেছেন তিনি।
আসিফের ভাষ্য, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার অভিযোগে বাদী (সাবেক স্ত্রী) যে বাড়িতে তাকে নির্যাতনের কথা বলেছেন, সেই বাড়িতে তিনি ও তার পরিবার কখনোই ছিলেন না। ধানমন্ডির সেই বাড়ি সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
ওই মামলার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে অর্নি প্রিয়.কমকে জানিয়েছিলেন, আসিফের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান আত্মীয়রা।
এ বিষয়ে আসিফ বলেন, ‘অর্নিকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে সার্টিফিকেট আদালতের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে, সে সার্টিফিকেটটি জাল।’
‘ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও এতদিন কেন বিষয়গুলো সামনে আনেননি?’
‘আমি অর্নির বিষয়ে কোনো অন্যায় ও মিথ্যার আশ্রয় নিইনি। আর তা প্রমাণ করার জন্যই আমি এতদিন চুপ ছিলাম। আর যেহেতু আইনিভাবে সামনে এগোচ্ছি, তাই আমাকেও কিছু বিষয়ে চুপ থাকতে হয়েছে’, প্রিয়.কমের প্রশ্নের জবাবে বলেন আসিফ।
১২ জুলাইয়ের আলাপের পরের দিন শুক্রবার সকালে রাজধানীর উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় বসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আসিফের। তিনি সে সময় এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, অর্নি মামলার জন্য যে কাগজপত্র প্রদান করেছেন, সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ একটি ছিল নিকাহনামা, যেটি ভুয়া।
এরপর ‘আসল’ নিকাহনামা দাবি করে একটি কপি এ প্রতিবেদককে দেন আসিফ। সে সময় তিনি দাবি করেন, তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে অর্নি আরও তিনটি বিয়ে করেছিলেন। তিনি ছিলেন তার (অর্নি) চতুর্থ স্বামী।
আসিফ দাবি করেন, ভুয়া কাগজপত্র ও জাল সার্টিফিকেটে দিয়ে মামলা করে কোনো সুবিধা করতে পারেননি অর্নি। এরপর তিনি (অর্নি) তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় আরেকটি মামলা করেন।
আসিফের অভিযোগগুলো কতটা সত্য?
আসিফের উল্লিখিত দাবিগুলো যাচাইয়ে অনুসন্ধানে নামে প্রিয়.কম। এর অংশ হিসেবে শুরুতেই ধানমন্ডির ৮/১ নম্বর রোডের ৭৭ নম্বর বাসায় যান এই প্রতিবেদক। ওই বাড়ির ১১ তলার ১১ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকার কথা মামলায় উল্লেখ করেছিলেন অর্নি। কিন্তু ওই বাড়ির এক নিরাপত্তারক্ষী জানান, সেখানে আসিফ কিংবা অর্নি থাকতেন না।
বাড়িটিতে গত আড়াই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তাকর্মীদের একজন বলেন, ‘আসিফ বা অর্নি নামে কেউ আসলে এই বাসায় ছিল না। তাদের নামও কখনো শুনি নাই।’
নিরাপত্তাকর্মীর বক্তব্য শোনার পর এ বিষয়ে আসিফের বক্তব্য জানতে চান প্রতিবেদক। সে সময় তিনি প্রিয়.কমকে জানান, তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ধানমন্ডির ৮/এ নম্বর রোডের ৩১৪ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
এই অভিনেতার কথা অনুযায়ী ১৩ জুলাই দুপুরে এ প্রতিবেদক যান ধানমন্ডির বাড়িতে। সে সময় সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমি এখানে চাকরি শুরু করার এক মাস পরই তিনি (আসিফ) এ বাসা থেকে চলে যান।’
প্রিয়.কমের কাছে আসিফের সরবরাহ করা নথি অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন অর্নি। হাসপাতালে আশরাফ হোসেন নামের একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন আসিফের সাবেক স্ত্রী।
বিষয়টি যাচাইয়ে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, এই নামের কোনো চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেলে আছে বলে তার জানা নেই।
শুক্রবার দুপুরে ডা. আলাউদ্দিন মুঠোফোনে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জানার পরে ওই বিভাগে (বহির্বিভাগ) খবর নিই। কিন্তু সেখানে আশরাফ হোসেন নামের কোনো ডাক্তার দায়িত্বরত নেই। তারপরও যদি আপনাদের আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে আপনি অফিশিয়ালভাবে যোগাযোগ করতে পারেন। তারপরও সে হিসেবে বলাই যায়, সার্টিফিকেটটি জাল, যেহেতু এ বিভাগে ওই নামে কোনো চিকিৎসক নেই।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আশরাফ হোসেন নামে কিংবা এই পদবির এমন চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেলে নেই। আমরা বিষয়টি খোঁজ নিয়েছি।
আমরা র্যাব কিংবা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সবসময় চেষ্টা করি, যাতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে না পারে। কিন্তু তাদের ধরতে পারছি না। এটা বাইরে থেকে কেউ করলে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।’
মামলার বাদী ও পক্ষভুক্তের ভাষ্য
মামলার বাদী ও আসিফের সাবেক স্ত্রী শামীমা আক্তার অর্নি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। মামলার নথি অনুযায়ী, তার ঠিকানা কলাবাগান। সেই বাড়িতে থাকেন অর্নির খালা দেলোয়ারা বেগম, যিনি আবার এই মামলার সাক্ষীও।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য মামলার এজাহারে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী, সেই বাসায় যান এই প্রতিবেদক। এরপর সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদীর পক্ষভুক্ত দীল আফরোজ খান হ্যাপী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আদালতের কাছে গিয়েছি। আদালত যে রায় দিবে, আমরা তা মেনে নিব। ‘‘ভুয়া কাগজপত্র ও জাল সার্টিফিকেট’’ দিয়ে হয়রানি করার যে অভিযোগ আসিফ তুলেছে, তা ভুয়া না সঠিক, তা আদালতই বিচার করবে। তার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা আশা করি ন্যায়বিচার পাব। বাকিটা দেখা যাক, কী হয়। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আর কথা বলতে চাই না।’

মামলা ও আসিফের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্নি কানাডা থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মেসেঞ্জারে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এ কথা সত্য না। আসিফ অনেকভাবে চেষ্টা করছে আমাদের হয়রানি করার জন্য। এ ছাড়া যেকোনোভাবে বিষয়টি ভুয়া প্রমাণ করার জন্য। আমি এ বিষয়ে চিন্তিত না। কোর্টে সব দেখা যাবে। কোর্টের বাইরে এসব নিয়ে কেন কথা হচ্ছে, আমি বুঝলাম না। টাকা দিলে আজকাল সবাই সব কথা বলে। আমরা কোর্টের বাইরে কোনো তামাশা করতে চাই না।
এসব যা ঘটছে, সব আসিফের সাজানো। ওই নামের ডক্টর না থাকলে আমার সার্টিফিকেটে সাইন কে করল? আমি ৫৭ ধারাতে মামলা করছি আসিফের বিরুদ্ধে। কারণ আসিফ ফেসবুকে আমার বিরুদ্ধে বাজে সব কথা লিখে যাচ্ছিল, যা সত্য না। তার অনেক প্রমাণ আমার কাছে আছে। তা আমি সব কোর্টে দিব। যাই হোক, কোর্ট ডিসাইড করবে সব। কোর্টের বিচার শেষ বিচার। সেটার ওপর কি আসিফের বিশ্বাস নেই?’
মামলা ও তালাক নোটিশের সারসংক্ষেপ
নির্যাতনের মামলায় চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টার পর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন থেকে আসিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মালয়েশিয়া থেকে নাটকের শুটিং শেষে দেশে ফিরছিলেন তিনি। পরের দিন সকালে আদালত দুই পক্ষের শুনানি শেষে আসিফকে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
দুই দিন পর ২৫ এপ্রিল স্ত্রীকে আর নির্যাতন না করা ও সন্তানের ভরণপোষণ দেওয়ার শর্তে আসিফকে জামিন দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক শফিউল আজম।’
কানাডাপ্রবাসী শামীমা আক্তার অর্নির সঙ্গে আসিফের পরিচয় হয়েছিল তার এক বন্ধুর মাধ্যমে। অর্নি কানাডায় নার্সিং পেশায় যুক্ত। কিন্তু আসিফ বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে প্রিয়.কমকে জানান, এ তথ্য মিথ্যা। সেখানে তিনি একটি হাসপাতালের অভ্যর্থনাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।
অর্নির করা নারী নির্যাতনের মামলায় আসিফ গ্রেফতার হন ২৩ এপ্রিল। পরে আসিফের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে ২৫ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত জামিন দেয়। সেই জামিনের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে আরও বাড়ানো হয়।
মালয়েশিয়া যাওয়ার আগেই ২ এপ্রিল অর্নির কাছে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছিলেন আসিফ। পরে ১ মে তালাক নোটিশ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেন অর্নি। একুশে মিডিয়া।
No comments:
Post a Comment