একুশে মিডিয়া, মুক্তমত:
লেখক-সাবরিনা ইসলাম নীড়:
শরীয়তপুরের মেয়ে জেনি অর্থাভাবে নবম শ্রেণিতেই থমকে দাঁড়ায় শিক্ষাজীবন। বাবা রাজমিস্ত্রী, নির্মাণ কাজের সময় ভবন থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু, ঘরে মা এবং আরো পাঁচটা বোন এমতাবস্থায় জেনি গাঁয়ের দুঃসম্পর্কের এক চাচীর হাত ধরে পাড়ি জমায় ঢাকা শহরে।প্রথম প্রথম কাজ জানেনা তাই
সামান্য বেতনেই যুক্ত হয়।বছরখানেক কেটে গেল
বোতাম শেলাই করতে, এরপর আস্তে আস্তে পোশাক
সেলাইয়ের কাজটা শিখে নেয় ক্রমেক্রমে বেতন ও
বাড়তে থাকে।চাচির সাথে পূর্ব রাজাবাজারের বস্তির
এক ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেয়।গাঁয়ের উদার আকাশ
খোলা মাঠ বিমল বায়ু অমন অকৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে
শহরের বস্তির গুমোট পরিবেশ অস্থির করে তোলে
তারপরেও বাঁচার তাগিদে পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে
চলতে হয় তাকে।প্রতিদিন পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলে যায়।
প্রচণ্ড যানজট এরই মাঝে হাজার হাজার গার্মেন্টস কর্মীদের পদব্রজে এগিয়ে চলা হঠাৎ একটা রিক্সা উঠিয়ে দেয় ওর পায়ের উপরে, জেনি চিৎ হয়ে পড়ে
যায় রিকশাওয়ালা নেমে এসে ওকে হাত ধরে রিক্সায়
তোলে তারপর আস্তে আস্তে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়।
জেনির সাথে রিকশাওয়ালার পরিচয় হয়,সে কুড়িগ্রামের আবুল,বয়স বিশ/ বাইশ দেখতে মন্দ নয়
ধনীর ঘরে জন্ম নিলে লোকে রাজপুত্তুর বলত যা হোক
ভাগ্য দোষে সে আজ রিকশাওয়ালা। জেনির কাছ থেকে জেনে নেয় কখন বাসায় ফিরবে,সময়মতো তাকে
বাসায় পৌঁছে দেয়।সে বাসায় ফিরে সারারাত আবুলকে
নিয়ে ভাবতে থাকে।আজ আর ঘুম আসছেনা,চোখ
বুজলেই আবুলের ছবি চোখের তারায় ভেসে ওঠে।
এমনতো কোনোদিন হয়নি! আজ হচ্ছে কেন?
রাত শেষ হয়ে আসছে, একটুখানি ঘুম না হলে পায়ে
হেঁটে অতদূর যাওয়া সম্ভব হবেনা।কিন্তু কি আর করা
ঘুম যে মনের অজান্তেই ঐ অচেনা ছেলেটা কেড়ে নিয়েছে। ভোরবেলা চাচী ডাক দেয় রান্না করতে,
এক উনুনে তিন/ চার ফ্যামিলির রান্না। দেরি হলে
মহা মুশকিল ঝগড়া বেঁধে যায় তুমুলবেগে।জেনি
রান্না সেরে গোসল করে অফিসের পথে রওনা হয়,
আজ আর কিছু খেতে ইচ্ছে হয়নি।রাতে ঘুম হয়নি
শরীরটা কেমন দুর্বল, পা চলছেনা বাসা থেকে বের
হতেই একটু দূরে রিকশা নিয়ে আবুল অপেক্ষা করছে।
আজও ওকে পৌঁছে দেয় সে।একটু একটু করে দুজনার
ভিতর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।প্রতিদিন সে আনা নেয়া
করে পথেই যেটুকু কথা হয়,তবে আবুলের ইচ্ছা জেনিকে নিয়ে কোনো এক শুক্রবারে ঘুরতে বেরুবে।
প্রাণ খুলে গল্প করবে, ঘুরবে ফিরবে ফুচকা খাবে।
মনের কথা জেনিকে বলতেই সে রাজি হয়।টিএসসি
চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেয়,আবুলের শখ ওখানেই জেনিকে নিয়ে যাবে।
যেমন ভাবা তেমন করা।দুজন বসে বসে গল্প করলো
তবে এ গল্প সেই রূপকথার গল্প নয়,এটা জীবনের গল্প
ভালোবাসার গল্প, দুটি মনের আবেগ উচ্ছ্বাসের গল্প।
দু'জনার মনের না বলা কথাগুলো আজ বলছে প্রাণখুলে। আবুল জেনির মাথা ছুঁয়ে শপথ করে
কোনোদিন ছেড়ে যাবেনা।জেনি কান্না জড়িত কন্ঠে
প্রশ্ন করে, যদি কোনোদিন এক্সিডেন্টে আমার পা দুইখান ভাইঙ্গা যায় তহন তুমি আমায় ফালায় যাইবা
নাতো?আবুল দৃঢ় কন্ঠে বলে, আমার জীবন থাকতে
তোমারে কোনোদিন ফালামু না।চোখ দুইডা কানা
হইয়া গেলেও তোমারে লইয়া ভিক্ষা কইরা খামু তবুও
তোমারে ছাড়মুনা।দিন-মাস-বছর যায় ওদের ভালোবাসা ক্রমান্বয়ে গাঢ় হতে থাকে।একনাগাড়ে
কয়েকবছর মেশিনের কাজ করতে করতে জেনির
চোখে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়।চোখ ঝাপসা হয়ে
আসে,একা সুঁই গাঁথতে পারেনা।আসলে কিশোরী মেয়ে
রাতদিন খাটাখাটুনি তারপর পুষ্টিকর খাবার জোটেনা
আর তা থেকেই এই সমস্যা। ডাক্তার বল্লেন বিশ্রাম নিতে,কিন্তু কাজ না করলে সংসার চলবে কি করে?
বাড়ির সবাই যে না খেয়ে মরবে।ডাক্তার মেশিনের কাজ
করতে জোরালো ভাবে নিষেধ করলেন,তিনি এ কথাও
বল্লেন,তুমি অন্ধ হয়ে গেলে তখন সংসার চলবে কীভাবে? সেভাবেই চলুক,তোমার চোখদুটো তো ভালো হোক।জেনি পারিবারিক সমস্যার কথা বুঝিয়ে
বল্লে ডাক্তার তাকে কিছুদিন পরে বাসাবাড়ির কাজের
ব্যাপারে সম্মতি দিলেন,প্রেসক্রিপশন নিয়ে আবুল নিজের পকেটের টাকায় ওষুধ কিনে দেয়।কিছুদিন পর
জেনি একটা বাসার কাজ পায়।ঐ বাসার মালিক
শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা টি রহমান।রহমান সাহেবের স্ত্রী এবং দুটো ছেলে। ওর কাজ দেখে মিসেস রহমান বেশ সন্তুষ্ট। রাত দশটা বাজে, গিন্নী ছেলেদুটো নিয়ে ছাদে
রহমান সাহেব চা দিতে বল্লেন,জেনি চা দিতে গেলে
বুকের ওড়নাটা সরে যেতেই সাহেবের নজর পড়ে সেদিকে। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে,এবার সে তার হাতপা
টিপে দিতে বলে।জেনি জড়তা নিয়ে একপা দুপা করে
এগুতে থাকে।করার কিছুই নেই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মালিকের কথা শুনতে হয়।হাত পা টিপতে টিপতে এক
ফাঁকে রহমান সাহেব জাপটে ধরে বুকের সাথে,
জেনি কোনোমতে ছুটে এসে সেদিন রেহাই পায়।
আসলে জেনির এখন ভরা যৌবন, চেহারাটা নজরে
পড়ার মতো।আমি নিজেই ওকে দেখলে আমার নারীত্বের কথা ভুলে যাই, মনে মনে আফসোস করি
হায় কেন পুরুষ হলাম না।আমার এমন ভাষ্য হয়তো
পাঠকদের হাসাতে পারে কিন্তু গল্পের নায়িকা ততটাই
সুন্দর, মানুষ যতটা পছন্দ করে। যা হোক সেদিন রাতে
জেনির ঘুম হয়নি,ভয়ে প্রাণটা দ্রু দ্রু কাঁপছে।
আবুলের সাথে তার পাঁচ বছরের সম্পর্ক, আজ অব্দি
সে তাকে ছুঁয়ে দেখেনি। কেবল হৃদয়ের সম্পর্ক,
শরীর ছোঁবে বিয়ের পরে,তেমনটাই শপথ তাদের।
ওদিকে রহমান সাহেবের আর ঘুম আসছেনা আজকে
সে কল্পনায় জেনিকে নিয়ে ছক কষে যাচ্ছে। ওকে
নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে। হঠাত স্ত্রীকে বল্লেন,ছেলে দুটোকে
নিয়ে ওদের নানার বাসা থেকে বেড়িয়ে এসো।
গিন্নী তো খুশিতে ডগমগ, সে একবাক্যে রাজি। পরদিন
শুক্রবার সকাল নটার দিকে মিসেস রহমান ছেলে দুটোকে নিয়ে রওনা হলেন।রহমান সাহেব বাসায় আছেন,আজ তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনিকে কাছে
পাওয়ার দিন।আজ আর জেনিকে ডাকেননি,নিজেই
তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।জেনি ছটফট করছে
কিন্তু আজ আর পালানোর পথ নেই।একে একে তার
যৌবনের পাপড়িগুলো নির্লজ্জের মতো ঝরাতে থাকে।
রহমান সাহেব তাকে অভয় দিতে থাকে এবং মাথা ছুঁয়ে
বারবার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়।আলাদা বাড়ি করে দেয়ার স্বপ্ন দেখায়, তার পরিবারের দেখভাল করার শপথ নেয়।জেনির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যখন সব হয়ে গেছে
তখন আর পিছু হটার উপায় নেই।জেনি লোভে পড়ে
জীবন যৌবন সমর্পণ করেনি,জোরপূর্বক তার সতীত্ব হরন করা হয়েছে।এখন পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে
তার সবকিছুই মেনে নিতে হয়।দিনের পর দিন মাসের
পর মাস মেয়েটিকে এভাবেই ভোগ করে চলে।
অনেকদিন হলো সে আবুলের সাথে দেখা করতে যায়না
এখন মনে মনে সে নিজেকে রহমান সাহেবের স্ত্রী বলেই
ভাবে।তার সতীত্ব হরন করেছে একজন,আবুলের জন্য
আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।তাই সে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে।এখন মনে মনে কেবল সাহেবের সাথে বিবাহের
দিন গুনছে।মেয়েরা এমনই সরল সহজ চিরকাল।
ভাবনার আড়ালে যে দুর্ভাবনা লুকিয়ে আছে,কথার
আড়ালে মিথ্যে বেড়াজাল তা ঐ অবুঝ মেয়েটা বুঝতে
পারেনি একেবারে অবোধ বালিকা।এভাবে চলতে চলতে হঠাত একদিন মিসেস রহমানের চোখে ধরা পড়ে
যায়।সে রেগেমেগে চিৎকার করে জেনিকে খুন করতে
যায়।রহমান সাহেব কোনোমতে ঠেকিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়।চিরদিনের মতো
বিদায়,আর কোনোদিন না আসার কথা বলে দেয়।
জেনির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।এখন সে কোথায়
যাবে? কী করবে? কিছুই বুঝতে পারেনা।জীবন যৌবন
হারানো মেয়েটা আর কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায়না।
তার যৌবনের মূল্য পাঁচ হাজার টাকা, তার সম্ভ্রমের মূল্য পাঁচ হাজার টাকা, তার বিশ্বাসের মূল্য মাত্র পাঁচ
হাজার টাকা।হতভাগিনী মেয়েটা আর কোনো বাসা
বাড়ির কাজ নেয়নি।সে মালা বিক্রির কাজ বেছে নেয়।
আবুল আর এ তল্লাটে নেই,সে জেনিকে হারিয়ে পশ্চিম
নাখালপাড়া ছেড়ে চলে যায় উত্তরা।বহুদিন পর জেনির
কথা মনে পড়তেই মন উতলা হয়ে ওঠে।নিজেকে কিছুতেই স্থীর রাখতে পারেনা।মনে পড়ে যায় টিএসসির
কথা।ছুটে যায় টিএসসি চত্বরে। বসে বসে স্মৃতির রোমন্থন করছে এরই মধ্যে চেনা সুরের হাঁক শুনে
চমকে উঠে দেখে তার স্বপ্নের রাণী মালা হাতে পাশ
দিয়ে হেঁটে যায়। আবুল ডাকলেও সে আর সাড়া দেয়না
এযেন অচেনা কেউ।আবুল কাছে এসে শক্ত করে হাত
ধরে, যেন ছুটে না যায়।সব জেনেও আবুল তার প্রেয়সীকে বরণ করে নেয়, কারণ এযে তার ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। আজ থেকে জেনির মালা
কেবল সে-ই পরবে অন্য কেউ নয়।পুরুষ মানেই নষ্ট
পুরুষ নয়,পুরুষ মানেই প্রতারক নয়
আর সে কারণেই জেনিদের কারোনা কারো বুকে ঠাঁই হয়।যেখানে মোটা মোটা বই পড়া একজন কর্মকর্তার
প্রতিশ্রুতির মূল্য পাঁচ হাজার টাকা, সেখানে আবুল
রিকশাওয়ালার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসের ডানায় ভর করে
ভালোবাসার আকাশ ছুঁয়েছে।
(সমাপ্ত)
একুশে মিডিয়া/এমএসএ
No comments:
Post a Comment