মোহাম্মদছৈয়দুলআলম:
চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণাংশের জনবহুল ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজারগামী সড়কটি বর্তমানে যেমন অতীব প্রয়োজনীয়, তেমনি তা সময়ের দাবি অনুসারে খুবই সংকুচিত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে উঠছে। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন- বিশেষ করে মালবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেটকার, অ্যাম্বুলেন্সসহ সকল প্রকার গাড়ী- এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। অথচ বহু স্থানে এটি এখনো দুই লেনও নয়; বরং অনেকটা সরু গলির মতো হয়ে গেছে।
বিকল্প সড়কের প্রয়োজনীয়তা:
এই সড়কটি কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প রুট হিসেবে বিবেচিত। কারণ মূল মহাসড়কে যানজট, মেরামত, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেকোনো সময় বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। এমতাবস্থায় বাঁশখালী হয়ে একটি বিকল্প মহাসড়ক নির্মিত হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার কমে যাবে, যা সময়, খরচ এবং কার্যকারিতার দিক থেকে অত্যন্ত লাভজনক হবে।
এই সড়ক শুধু পর্যটন নয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অর্থনৈতিক করিডোরকে কেন্দ্র করে পণ্য পরিবহন ও আঞ্চলিক ব্যবসায়িক যোগাযোগে নতুন গতি এনে দিতে পারে।
বর্তমান সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ: সমস্যার পাহাড়:
বাঁশখালী প্রধান সড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করার প্রস্তাব বহুবার এসেছে। স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি সকলেই বিষয়টি নিয়ে সরব। তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, এই সড়কের দুই পাশ জুড়ে রয়েছে:
ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা, হাট-বাজার, অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট ও দোকান, মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও প্রশাসনিক ভবন।
এই সব স্থাপনা ও জনবসতি সরিয়ে চার লেনের কাজ করতে গেলে:
বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে লক্ষাধিক পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হবে সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয় এবং পুরো প্রকল্পটি হবে সময়সাপেক্ষ ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
প্রতিটি কিলোমিটারে জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো অপসারণে ব্যয় হবে কোটি কোটি টাকা। এভাবে এগোলে প্রকল্পের গতি শ্লথ হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশের অর্থনীতিতেও চাপ ফেলবে।
গ্যাস লাইন করিডোর: এক সম্ভাবনার জানালা:
এই পরিস্থিতিতে বিকল্প ও বাস্তবমুখী একটি ভাবনার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সেটি হলো: কক্সাবাজারের মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইনের করিডোর। এই গ্যাস লাইনটি রয়েছে বাঁশখালী প্রধান সড়কের একেবারে কাছাকাছি অবস্থানে, প্রায় সমান্তরালভাবে বিস্তৃত। এর ফলে যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এটি একটি সড়ক করিডোর হিসেবেও ব্যবহারের উপযোগী হতে পারে।
এই পাইপলাইনের দুপাশেই সরকারের নির্ধারিত গ্যাস পাইপলাইনটি পথাধিকারের অধিকার অনুযায়ী নির্ধারিত করিডোর বরাবর স্থাপনা রয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো গ্যাস লাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটি এখনো কোনো সড়ক প্রকল্পের আওতায় না থাকলেও, বাস্তবিক দিক থেকে এটি একটি সম্ভাব্য বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।
এই করিডোর ব্যবহার করলে উপকারিতা কী?
জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন নেই, কারণ এটি সরকারের মালিকানাধীন। স্থাপনা উচ্ছেদের ঝামেলা নেই, বসতি বা মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। মানবিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি প্রায় শূন্য। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সময়ের অপচয় কমবে, দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব।
বিশ্বের বহু দেশে পাইপলাইন, বিদ্যুৎ লাইন কিংবা সেতু করিডোরের পাশ দিয়েই রক্ষণাবেক্ষণ সড়ক নির্মাণ করা হয়, যা পরবর্তীতে যানবাহন চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মতো ভূখণ্ডে এ ধরনের সমন্বিত অবকাঠামো পরিকল্পনা নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
পরিকল্পনায় নতুন চিন্তার প্রয়োজন:
আমরা যদি সবকিছু “এমনটাই চলে আসছে”- এই মনোভাব নিয়ে বিবেচনা করি, তাহলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। উন্নয়নের জন্য চাই সময়োপযোগী, টেকসই ও ব্যয়সাশ্রয়ী সিদ্ধান্ত। বাঁশখালী সড়ক চার লেনে উন্নীত করতেই হবে- এই বক্তব্যে দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেটি কোন পথে?
সরকার যদি গ্যাস লাইন করিডোরকে রোড নেটওয়ার্ক হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে, তাহলে অনেক কম সময় ও ব্যয়ে জনগণকে আধুনিক যোগাযোগ সুবিধা দেওয়া সম্ভব। তদ্ব্যতীত, এই রুটটি ভবিষ্যতে শিল্প এলাকা, ইকোনমিক জোন ও পর্যটন নগরীর সঙ্গে সংযুক্তিকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার:
আমি কোনো পক্ষের পক্ষে সওয়াল করছি না। বরং বর্তমান বাস্তবতা, খরচ, জনভোগান্তি এবং দীর্ঘমেয়াদি সুফলের বিবেচনায় একটি যুক্তিনির্ভর বিকল্প চিন্তার অবতারণা করছি মাত্র। গ্যাস লাইন করিডোরটি যদি সত্যিই বাঁশখালী প্রধান সড়কের সমান্তরালে চলে থাকে, তাহলে এটি একটি দারুণ সুযোগ- যা হয়তো আর কখনো আসবে না। ভাবনার সময় এখনই। আজকের একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা আগামী প্রজন্মের জন্য স্থায়ী উন্নয়নের বুনিয়াদ গড়ে তুলতে পারে। জনপ্রিয়তা নয়, প্রজ্ঞা ও পরিকল্পনাই হোক উন্নয়নের মানদণ্ড।
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদক ও প্রকাশক: একুশে মিডিয়া
No comments:
Post a Comment