মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
সংবাদমাধ্যম সমাজের আয়না। অপরাধের সংবাদ প্রচার- বিশেষ করে অপরাধী বা সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ- এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। একটি ছবি প্রকাশ মানে শুধু তথ্যপ্রদান নয়; এর মাধ্যমে একজন মানুষের জীবন, সম্মান, ভবিষ্যৎ, সামাজিক অবস্থান, বিচার প্রক্রিয়া- সবকিছুই প্রভাবিত হতে পারে। তাই এই বিষয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিশেষ সতর্ক থাকা জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন, আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নীতিমালা- এসব বিবেচনায় ছবি প্রকাশের বিষয়টি ক্রমেই কঠোর নৈতিকতার আওতায় এসেছে।
এই কলামে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো- সংবাদমাধ্যম কাদের ছবি প্রকাশ করতে পারবে, কাদের ছবি একেবারেই প্রকাশ করা যাবে না, এবং কোন পরিস্থিতিতে প্রকাশ করলে আইনগত জটিলতা তৈরি হতে পারে।
সংবাদমাধ্যম যাদের ছবি প্রকাশ করতে পারবে:
১. আদালতে দোষী সাব্যস্ত অপরাধী- যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালত ইতোমধ্যে রায় ঘোষণা করেছে, তাদের ছবি প্রকাশ আইনি ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। প্রমাণিত অপরাধীর পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করলে- জনগণ সঠিক তথ্য পায়, অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। তবে কারাগারে গোপনে তোলা ছবি বা অপমানজনক ভঙ্গির ছবি প্রকাশ করা যাবে না। কারা আইন-২০০৬ অনুযায়ী এটি বিচ্ছিন্নভাবে দণ্ডনীয় হতে পারে।
২. রাষ্ট্রীয় সংস্থার আনুষ্ঠানিকভাবে সরবরাহকৃত ছবি; পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (PBI), র্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, CID বা পুলিশ সদর দপ্তরের অফিসিয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রদর্শিত ছবি সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে- পুলিশ ছবি দিলেই ব্যক্তি অপরাধী প্রমাণিত হয়ে যায় না। তাই ‘গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি’, ‘সন্দেহভাজন’, ‘অভিযুক্ত’- এই শব্দগুলো ব্যবহার জরুরি।
৩. জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য ‘ওয়ান্টেড’ অপরাধীর ছবি; এদের মধ্যে রয়েছে, পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি, জঙ্গি সংগঠনের সদস্য, সন্ত্রাসী বা সিরিয়াল অপরাধী, রাষ্ট্রবিরোধী, নাশকতাকারী, মানবপাচারকারী, অস্ত্র ডিলার, চোরাকারবারি, বড় ধরনের অর্থপাচার বা দুর্নীতির মামলার পলাতক আসামি, রাষ্ট্রীয় সংস্থা চাইলে এই ধরনের ছবি মিডিয়া প্রকাশ করতে পারবে।
৪. প্রকাশ্য অপরাধ সংঘটনের ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি; যদি কোনো অপরাধ সিসিটিভি বা মোবাইল ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং জনগণকে সতর্ক করা জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় হয়, তখন মুখ ঝাপসা করে বা সীমিত অংশ দেখানো যেতে পারে।
উদাহরণ; ব্যাংক ডাকাতির দৃশ্য, রাস্তার ছিনতাই, গণপরিবহনে যৌন হয়রানি, বাস বা দোকানের ভাঙচুর।
৫. জনস্বার্থে তদন্তমূলক প্রতিবেদনে প্রকাশযোগ্য ছবি; যদি সাংবাদিকতার তদন্তে এমন তথ্য উঠে আসে যা রাষ্ট্রীয় বা সরকারি স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ, তখন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণাকারী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, ইত্যাদির ছবি প্রকাশ করা যেতে পারে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।
তবে এই প্রকাশনা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য তথ্যপ্রমাণ দ্বারা ব্যাক-আপ থাকতে হবে।
যাদের ছবি কখনোই প্রকাশ করা যাবে না:
১. নাবালক (১৮ বছরের কম বয়সী); অপরাধী হোক বা ভুক্তভোগী, বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩-এর ৩২ ধারা অত্যন্ত কঠোর- কোনো শিশুর ছবি বা পরিচয় প্রকাশ করলে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
মিডিয়া কখনোই প্রকাশ করতে পারবে না;
শিশুর ছবি, স্কুল, গ্রাম, অভিভাবকের পরিচয়, ভিডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট।
এটি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
২. ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার ভুক্তভোগী; এটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি ‘জিরো টলারেন্স’ বিষয়। ধর্ষণ মামলার, ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার, ঠিকানা, ছবি, ভিডিও কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তির নারী পরিবারের সদস্যদের ছবিও প্রকাশ করা যাবে না।
৩. সন্দেহভাজন ব্যক্তি (যাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়নি); গ্রেপ্তার হওয়া মানেই অপরাধী নয়। বাংলাদেশের সংবিধান (৩৫(৩) অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী- প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সকলেই নির্দোষ। সন্দেহভাজন ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করলে- মানহানি মামলা হতে পারে, আদালত ‘Contempt of Court’ বিবেচনা করতে পারে, তদন্তে প্রভাব পড়তে পারে, ব্যক্তি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
৪. গৃহকর্মী, প্রবাসী শ্রমিক বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের সদস্য; মিডিয়া এদের ছবি প্রকাশ করলে সমাজে বৈষম্য বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই জাতিসংঘের মানবাধিকার নির্দেশিকা অনুযায়ী- অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
৫. হ্যান্ডকাফ পরা বা পুলিশের নির্যাতনের চিত্র; আদালত বারবার বলেছে- হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থায় ছবি প্রকাশ মানবাধিকার লঙ্ঘন। অত্যাচারের ছবি প্রকাশ করা গোপনীয়তা ও মর্যাদা হানিকর। মহান বিচারিক আদালত ২০২০ সালে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন- প্রয়োজন ছাড়া হ্যান্ডকাফ ব্যবহার করা যাবে না, এবং মিডিয়ায় তা প্রদর্শনও নয়।
আইনগত দিকসমূহ: মিডিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
১. সংবিধান (Article 32, 39); ব্যক্তিগত মর্যাদা, গোপনীয়তার অধিকার, সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা (কিন্তু দায়িত্বসহ)
২. দণ্ডবিধি ৫০০ ও ৫০১; মানহানি আইন। যে কোনো ব্যক্তি ছবি প্রকাশের কারণে মানহানির শিকার হলে মামলা করতে পারেন।
৩. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন; ভুল তথ্য, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি প্রচার, কিংবা প্রাইভেসি লঙ্ঘন করলে কঠোর বিচার হতে পারে।
৪. প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; সাংবাদিকতার নৈতিক বিধিমালা লঙ্ঘন করলে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যেতে পারে।
৫. শিশু আইন ২০১৩; নাবালক সম্পর্কিত ছবি প্রকাশ করলে কড়া শাস্তি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণে করণীয়:
১. Presumption of Innocence; অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।
২. Do No Harm প্রিন্সিপাল; কোনো তথ্য বা ছবি প্রকাশ করলে যাতে অহেতুক ক্ষতি না হয়।
৩. Minimal Exposure Theory; যে ছবি ছাড়া গল্প বলা সম্ভব, সেখানে ছবি না ব্যবহার করাই উত্তম।
৪. Victim-Centered Approach; ভুক্তভোগীর মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
সাংবাদিকদের জন্য করণীয়-বর্জনীয়:
যা করবেন- অফিসিয়াল তথ্য যাচাই করুন, সন্দেহভাজন শব্দ ব্যবহার করুন, মুখ ঝাপসা করে প্রকাশ করুন, প্রাইভেসি ও সম্মান রক্ষা করুন, আদালতের রায়, নির্দেশনা অনুসরণ করুন, প্রমাণ ছাড়া কারো ছবি ব্যবহার করবেন না।
যা কখনো করবেন না: শিশু অপরাধীর ছবি প্রকাশ, ধর্ষণ ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ, হ্যান্ডকাফ পরা ছবি প্রকাশ, গুজব বা যাচাইবিহীন ছবি শেয়ার, অপরাধ প্রমাণের আগে কাউকে ‘অপরাধী’ উল্লেখ, পরিবারের নির্দোষ সদস্যদের ছবি প্রকাশ।
সমাপনী কথা:
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যেমন রাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, তেমনি মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা একজন ব্যক্তির জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। একটি ভুল ছবি প্রকাশের কারণে- নির্দোষ মানুষ অপরাধী হয়ে যেতে পারে, বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে, সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হতে পারে, চরম মানসিক আঘাত সৃষ্টি হতে পারে, সুতরাং, প্রতিটি ছবি প্রকাশের আগে সাংবাদিকদের নিজেদের কাছে প্রশ্ন করা উচিত-
“এটি কি সত্যিই জনস্বার্থে প্রয়োজনীয়?”
“এটি কি প্রমাণসাপেক্ষ?”
“এটি কারো মর্যাদা বিনষ্ট করবে না তো?”
“এটি কি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?”
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হলো-
মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, সত্য এবং নৈতিকতার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা।
লেখক
সাংবাদিক ও কলাম লেখক





No comments:
Post a Comment