রুশমী আক্তার, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজানের তহশিলদার পাড়ার বাসিন্দা রঞ্জিত দাশ ও কৃষ্ণা দাশের মেয়ে পিউ দাশ জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী। ১৯৯৯ সালে জন্ম নেওয়া পিউ দাশ দৈহিক গঠনগতভাবে অত্যন্ত খাটো এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। অন্যের সহায়তা ছাড়া কিংবা লাঠির ভর না নিয়ে হেঁটে চলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব প্রায়।
শৈশব থেকেই মা-বাবার স্নেহ-মমতায় বড় হওয়া পিউ দাশের মনে ধীরে ধীরে শিক্ষার প্রতি স্বপ্ন জন্মায়। সন্তানের শিক্ষালাভের ইচ্ছা বুঝতে পেরে মা কৃষ্ণা দাশ বাড়িতেই তাঁকে বর্ণপরিচয় শেখাতে শুরু করেন। পরে পাঠ্যজ্ঞান অর্জনে সক্ষম হলে বাড়ির সামান্য দূরত্বে অবস্থিত পূর্ব সুখছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান তাঁকে।
প্রতিদিন মা কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন, ক্লাস শেষে আবার কোলে করে বাড়ি ফিরতেন। শিক্ষকরাও এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন।
‘পিউ আমার কাছে ছিল একেবারে পুতুলের মতো’ - মা কৃষ্ণা দাশ
সম্প্রতি এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণা দাশ জানান, শৈশবে তাঁর মেয়ে ছিল একেবারে পুতুলের মতো নাজুক। সংসারের আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও মেয়ের শিক্ষা বন্ধ করেননি কখনো।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে পিউ দাশকে ভর্তি করানো হয় সুখছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। একইভাবে কোলে-পিঠে করেই চলতে থাকে মেয়ের স্কুলজীবন। শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৩.১১ পান পিউ।
এতে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন সাতকানিয়া এমএ মোতালেব কলেজে। কলেজ জীবনের প্রতিটি দিনও শেষ হয় মায়ের সেই আগের সংগ্রামে—কোলে করে আনা-নেওয়া।
সড়ক দুর্ঘটনা থামিয়ে দিল শিক্ষাজীবন:
২০২০ সালে এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষা চলাকালে পঞ্চম বিষয়ের পরীক্ষায় যাওয়ার পথে লোহাগাড়ার বার আউলিয়া মাজারসংলগ্ন আরকান সড়কে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েন পিউ দাশ। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দুর্ঘটনার কারণে তিনি বাকি নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি, ফলে চূড়ান্ত এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করাও সম্ভব হয়নি।
মা কৃষ্ণা দাশ বলেন, “দুর্ঘটনাটা আমাদের সব আশা ছিঁড়ে দিয়েছে। পিউর কলেজজীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। এখন ও শুধু আমাদের পরিবারের স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে।”
পরিবারের অকৃত্রিম স্নেহই তাঁর শক্তি:
আর্থিক কষ্টের মধ্যেও পিউ দাশকে ঘিরে পরিবারের সদস্যদের স্নেহ-মমতা কমেনি একটুও। সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে পরিবার কিছুটা সহযোগিতা পেলেও মেয়েকে আগলে রাখার সংগ্রাম থেমে নেই মা-বাবার।
মা বলেন, “যতটুকু পারি, আমরা সবাই মিলে ওকে ভালোবাসা দিয়ে লালন করি। ওর হাসিটাই আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি।”




No comments:
Post a Comment